জেদ
-অঞ্জনা গোড়িয়া
তানিয়াকে নিয়ে একেবারে প্রিন্সিপালের সামনে। ছটপটে মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে গেছে। মুখে কথা নেই।
তবু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তানিয়ার বাবা। মুখে মৃদু হাসি। প্রিন্সিপ্যাল হতবাক।
কী ব্যাপার? তানিয়ার এ কি অবস্থা? ওর কী হয়েছে? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
তানিয়ার বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, হয় পরীক্ষা নিন। নয় তো উত্তীর্ণ করে দিন মেয়েকে। নাহলে ওকে বাঁচাতে পারবো না।
দুজনেই নিজ নিজ সিদ্ধান্ত থেকে অনড়।
দুই মেয়ে। তানিয়া আর নাজিমা।
পড়াশোনায় বেশ ভালো। গরীব বাবার স্বপ্নটা তারা পূরণ করবেই। বাবার স্বপ্ন মেয়েদের ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।
তাই অভাবের সংসারে থেকেও মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি। পড়াশোনায়ও খারাপ নয়।
যদিও তিনি জানতেন, এই স্কুলে পড়াশোনা মানে বিশাল খরচ। কী করে সামলাবে?
প্রিন্সিপ্যাল সব জেনে কিছুটা মাহিনা ছাড় দিয়েছিলেন।
বাবার রোজকার বলতে পুরানো লোহা ভাঙা কাঁচ ভাঙা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে সংগ্রহ করা। তা নিদিষ্ট দপ্তরে গিয়ে বিক্রি করা। সেই সঙ্গে বাসনপত্র বিক্রি করা। চলে যেত ভালোই।
কিন্তু সমস্যা হলো করোনা আর লকডাউন। স্কুল বন্ধ হলো। কারবারও বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হলো অনলাইন ক্লাস। চাই একটা স্মার্টফোন। দু’টো মেয়ের জন্য দু’টো ফোন। কোথায় পাবে ফোন কেনার টাকা? আর কেনই বা কিনবে?
এখানেই বাবার তীব্র আপত্তি। কিছুতেই মেয়েদের হাতে ফোন তুলে দেবে না।
বাড়িতে এখন একটাই ফোন। তাও কি প্যাড। যদিও স্মার্টফোন একটা কিনে দিতেই পারে। তবু ফোন হাতে দেবে না মেয়েদের। বাবার কথায় শেষ কথা। মেয়েদের হাতে ফোন দেব না। ফোন যত সর্বনাশের মূল।
স্কুলে অনলাইন ক্লাস শুরু। কিন্তু দুইবোনের অনুপস্থিতি। বাবাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্লান্ত দুই বোন। বাড়িতে মেয়েরা নিজেদের চেষ্টায় অনেক খানি শিখেছে। কিন্তু ক্লাস করে নি। তাই প্রত্যেকটা ক্লাসে অনুপস্থিতি। এমন কি অনলাইন পরীক্ষা তাও দেওয়া হলো না। বড় মেয়ে বারবার করে বললো, একটা ফোন কিনে দাও বাবা। দু’বোনে ভাগ করে ঠিক পরীক্ষা দেবো।
বাবার জেদ কিছুতেই দেবো না ফোন। কেউ পরীক্ষা দিতে পারলো না। ক্লাস না করায় নিয়ম অনুযায়ী দুইবোনই ক্লাসে উত্তীর্ণ হলো না। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে একবছর থাকা মানে বিশাল খরচ। তার ওপর ওরা বাড়িতে পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নিয়ে ছিল পরীক্ষার।
যদি একবার অফলাইন পরীক্ষা দিতে সুযোগ পায় নিশ্চয় পাশ করবে। কিন্তু স্কুলের নিয়ম সবার জন্য এক।
যেদিন মার্ক শিট দিল স্কুলে, ঘটে গেল সেই ভয়ানক ঘটনা। বড় মেয়ে কয়েকটা ঘুমের ওষুধ একসাথে খেয়ে ফেললো। আর ঘুম ভাঙলো না। ঘটে গেল বিপত্তি। হসপিটালে ভর্তি করতে হলো। ধীরে ধীরে সেরে উঠেছে ঠিকই কিন্তু প্রাণ চঞ্চলা মেয়েটা কেমন ঝিমিয়ে গেল।
ফাদার সব জেনেও নিজ সিদ্ধান্তে অনড়। নিয়ম বিধি ভাঙতে পারবে না।
বাবার এক কথা এভাবে স্মার্টফোন কিছুতেই দেবো না মেয়েদের। তারও কারণ ভয়ানক। আজও মনে পড়লে শিউরে ওঠে বাবা।
স্মার্টফোনের কারণেই নিজের ছেলেকে বছর দুয়েক আগে হারিয়ে ফেলেছে। একটা কষ্ট করে স্মার্টফোন কিনে ছিল। সবার সুবিধার জন্য।
ছোট ছেলে লুকিয়ে ফোনে গেম খেলার নেশায় বুঁদ হয়ে গেল। একদিন ভয়ানক সেই খেলায় অসুস্থ হয়ে মারা গেল। বাড়ির সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুতেই মানতে পারে নি এই মৃত্যু। এর জন্য স্মার্টফোনকেই কাঠগোড়ায় তোলে বাবা।
তারপর থেকে বাড়িতে নেই স্মার্টফোন। কোনোদিন কিনবেও না ফোন। তাই আর অনলাইন ক্লাসও করতে পারবে না দুই বোন। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কায় বড়ো মেয়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
সব শুনে তানিয়ার জেদের কাছে মাথা নত করলো দুই ফাদার। করোনা পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক স্কুল যত দিন না হচ্ছে এভাবেই ক্লাস করতে হবে মেয়েদের। বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটা স্মার্টফোন দেওয়া হলো স্কুল থেকে। কিন্তু কড়া নির্দেশ ক্লাস আর নোট লেখার পর অফ রাখতে হবে ফোন।
তানিয়া তাতেই রাজি।
এখন দুই বোনে স্মার্ট ফোনেই ক্লাস করছে। এবছর অনলাইন পরীক্ষায় তারা সবচেয়ে ভালো ফল করেছে। তবে ফাদারের কথা মতো ক্লাস শেষে ফোনটা থাকে বাবার কাছে। তাতে কোনো আপত্তি নেই। স্মার্টফোন এখন ক্লাসরুম। স্মার্টফোন নিয়েই চলছে পড়াশোনা। তানিয়ার জেদের কাছে মাথা নত করলো বাবা।